ভ্যালি অব ডলসঃ স্কুল যখন পুতুলের!

জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশটির স্থাপত্য, প্রাচীন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে ধরে রাখার অদম্য চেষ্টায় কখনোই কোনো ত্রুটি ছিল না। পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের জন্য আদর্শ স্থান জাপান। এটি ৬ হাজার ৮৫২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। অসংখ্য দ্বীপের এ দেশটিতে হোনশু, হোক্কাইদো, ক্যুশু আর শিকোকু সবচেয়ে বড় দ্বীপ। এই চারটি দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও কম বসতির দ্বীপ শিকোকু। দ্বীপটির আয়তন ১৮ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার। শিকোকুর ছোট্ট উপত্যকা লিয়ার পাশ দিয়ে শিকোকুর প্রধান নদী য়োশিনো বয়ে চলেছে। এই উপত্যকারই একটি অংশে অবস্থিত গ্রামের নাম ‘নাগোরো’। গ্রামটি দেখতে অপরূপ, ছবির মতো সুন্দর হলেও এখানে যাওয়ার পর হঠাত গা ছমছম করে উওঠতে পারে নিঃসন্দেহে। একসময় ৩০০ জনসংখ্যার বাস থাকলেও এখন প্রায় জনমানবহীন একটি গ্রাম নাগোরো।

নাগোরা গ্রামের সৌন্দর্য (ছবিঃ সংগৃহীত)

এমনিতেই জাপানের জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। নাগোরা গ্রামটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এক তথ্যমতে, ২০১৫ সালে গ্রামটিতে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ এবং ২০১৬ সালে তা কমে ৩০-এ দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এ গ্রামে ২৭ জন বাসিন্দা আছেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী ব্যক্তির বয়স ৫০ বছর। সর্বশেষ যে শিশুটি এই গ্রামে জন্মে তাও ১৯ বছর আগে। তরুণদের সংখ্যা এ গ্রামে একদম শূন্যের কোঠায়। নাগোরো গ্রামের সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশনে যেতেও সময় লাগে এক ঘণ্টার বেশি।

মানুষের গ্রাম যখন পুতুলের

সৌন্দর্যে ঘেরা এই গ্রামে নিস্তব্ধতা যেন চারদিকে চিৎকার করছে। গ্রামের বেশির ভাগ লোক বয়স্ক বলে ঘরের বাইরে তাদের বেশি একটা দেখা যায় না। এমন একটি দৃশ্য দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল সুকিমি আইয়ানোর। তিনি এ গ্রামেরই একজন বাসিন্দা ছিলেন। শৈশবে তিনি যখন গ্রামে ছিলেন, তখন এখানে ৩০০ জনের মতো বাস করতেন। এমনকি যখন সর্বশেষ দুজন শিক্ষার্থীও স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে শহরে চলে গেলো তখন নাগোরোর একমাত্র স্কুলটিও বন্ধ হয়ে যায় ২০১২ সালে।

পুতুল বানাচ্ছেন সুকিমি। ছবিঃ সংগৃহীত

ওসাকা থেকে সুকিমি ফিরে আসেন ২০০২ সালে। বাবার অসুস্থতার জন্য সুকিমির ২০০২ সালে এ গ্রামে ফিরে আসা। পরিচিত যাদের জীবিত রেখে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই মারা গেছেন। প্রতিবেশীদের অনেকেই জাপানের বড় শহরগুলোতে চলে গেছেন অর্থনৈতিক উন্নতির আশায়। পুরো গ্রাম ঘুরেও সবগুলো প্রিয় মুখ খুঁজে পেলেন না সুকিমি।

অসুস্থ বাবা নিজ বাগানে বুনেছিলেন মুলা আর মটরশুঁটির বীজ। কিন্তু চারা বের হলেই পাখি সেগুলো খেয়ে ফেলত। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এক দিন নিজের বাগানের জন্য বাবার মুখের আদলে কাকতাড়ুয়া বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন সুকিমি। ঠিক কাকতাড়ুয়ার মতো নয় বলে পাখিরাও পুতুলকে মানুষ ভেবে ভুল করে বাগানে আর এলো না। ঠিক সে সময় সুকিমি চাইলেন গ্রামে মানুষ না থাকলেও সব জায়গা একেবারে মানুষবিহীন না থাকুক। এতে অন্তত মানুষের অভাবের দুঃখ কিছুটা হলেও কমবে। সে আশা থেকেই তিনি শুরু করলেন পুতুল বানানোর কাজ। গ্রামের হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা স্মরণ করে একের পর এক পুতুল বানানোর কাজে হাত দিলেন সুকিমি।

ছবিঃ সংগৃহীত

পুরনো সময়ের কথা সুকিমি সবচেয়ে বেশি মনে করতেন গ্রামে এসে। শুরুতেই তিনি একটি পুতুল বানিয়েছিলেন একজন মৃত প্রতিবেশীর আদলে, যার সঙ্গে সুকিমি রোজ কথা বলতেন। যেই মানুষগুলো হারিয়ে গেছে তাদের আদলে একের পর এক পুতুল বানানো শুরু করলেন তিনি। এই পুতুলগুলো বানানোর আগে গ্রামটি নিতান্তই সাধারণ এক গ্রাম ছিল। কেউ গ্রামটি নিয়ে ভাবত না। ২০১৪ সালে জার্মান ফিল্ম মেকার ফ্রিটজ স্কুম্যান ২০১৪ সালে সুকিমির পুতুলের কাজ নিয়ে ‘ভ্যালি অব ডলস’ অর্থাৎ ‘পুতুলের উপত্যকা’ নামে একটি ছোট ডকুমেন্টারি বানান। এরপর থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে নাগোরো গ্রামটি নতুনরূপে পরিচিত হয়ে ওঠে।

ছবিঃ সংগৃহীত

প্রাণহীন গ্রামে নতুন জীবন

২০০৩ সালে সুকিমি প্রথম পুতুলটি তৈরি করেন তার কৃষিজমির জন্য। এরপর প্রতিবেশীদের মুখের আদলে বানান আরও কটি পুতুল। বানানো শেষে পুতুলগুলো এমনভাবে প্রতিবেশীদের বাড়ির সামনে রাখেন, দেখে মনে হয় সেগুলো একে অন্যের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছে সেই পুরনো দিনের মতো। হারানো মানুষগুলোর আদলে সুকিমি একের পর এক পুতুল বানিয়ে যেতে লাগলেন। শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবার মতো করেই পুতুল বানিয়ে সাজিয়ে ফেললেন পুরো গ্রাম। 

ছবিঃ সংগৃহীত

কোনো পর্যটক যদি নাগোরো গ্রামে ঘুরতে যান, হুট করে গ্রাম দেখে তারা বিস্মিত হয়ে যান। মাঠে কৃষিকাজ করতে থাকা কোনো কৃষক, নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে থাকা সদ্য বিবাহিত জুটি, ছোট্ট মেয়েকে পাশে বসিয়ে কোনো বাবা হয়তো বড়শি হাতে মাছ ধরছেন, গায়ে কোট আর মাথায় টুপি পরে কয়েকজন মিলে হয়তো বাগানের কাজ নিয়ে আলোচনা করছেন এমন দৃশ্য নাগোরো গ্রামে এখন একদম সাধারণ। প্রতিটি দৃশ্যই একদম বাস্তব মনে হয় এখানে। পার্থক্য শুধু একটাই, এদের কারও মধ্যে প্রাণ নেই সবগুলোই পুতুল।

পুতুলের স্কুল

গ্রামে ফিরে এসে কোনো শিশুকেও দেখতে পাননি সুকিমি। এ নিয়েও তার আফসোস ছিল অনেক। যদি কোনো শিশু বা কিশোরের দেখাও তিনি পেতেন, তবে হয়তো তার সময়টা আরও ভালো কাটত। শিশুদের কোলাহল সবচেয়ে বেশি শোনা যায় স্কুলে। কিন্তু নাগোরো গ্রামের স্কুলে ছিল না কোনো শিশুর কোলাহল, দুরন্ত ছোটাছুটি। কোলাহলবিহীন, ধুলোমাখা, মাকড়সা আর পোকামাকড়ে ভরা স্কুলের জন্য সুকিমি ভাবতে লাগলেন কীভাবে প্রাণবিহীন স্কুলেও প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়। সেই ভাবনা থেকেই স্কুল ভবনগুলোতেও সুকিমি ছাত্রছাত্রীদের আদলে বেশ কটি পুতুল বানিয়েছেন।

ছবিঃ সংগৃহীত

পুতুলগুলোর মধ্যে দুষ্টুমি ভরা চেহারা দিয়েছেন। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, সেখানে আছে শিক্ষক, বাবা-মাসহ প্রয়োজনীয় সব চরিত্র। স্কুলের ১২টি ক্লাসরুমের প্রতিটিতে ঘুরতে গেলে দেখা যায়, শিক্ষক টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া বোঝাচ্ছেন আর শিক্ষার্থীরাও বেশ মনোযোগের সঙ্গে তার কথা শুনছে। প্রতিটি ক্লাসরুমের বেঞ্চে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে মানুষরূপী পুতুলশিক্ষার্থী। তাদের সামনে বই, খাতা রাখা আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ হয়তো খাতায় দাগ কাটছে, কেউ বই পড়ছে, কেউবা পাশেরজনের সঙ্গে গল্প করছে। সুকিমির বানানো পুতুলগুলো দেখে যে কেউ এক মুহূর্তের জন্য হলেও এগুলোকে বাস্তব বলে ভুল করবেন। সাজানো স্কুলে প্রাণের স্পন্দন ছাড়া সবকিছুই আছে।

ছবিঃ সংগৃহীত

পুতুলের কমিউনিটি সেন্টার

বিয়ে মানেই উৎসবের আয়োজন। অনেক মানুষ, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা আর দুজন নতুন মানুষকে ঘিরে সবার আগ্রহ। নাগোরো গ্রামে মানুষ না থাকলেও কমিউনিটি সেন্টারটি এখনো আছে। আর সেটি পুতুল দিয়ে সাজিয়েছেন সুকিমি। স্টেজে ওয়েস্টার্ন আর জাপানিজ পোশাকের নকশায় কাপড় পরানো হয়েছে বধূ আর বরকে। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ছয়জন ছোট বালক। পর্যটকরা এলে সত্যি বিয়ে না হোক, পুতুলের বিয়ে দেখে যেতে পারেন।

কী দিয়ে বানানো হয় পুতুল

সুকিমি কীভাবে পুতুল বানান সেই কাজ যদি সরাসরি কেউ দেখতে চান, তবে সেই সুযোগও আছে। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসের চতুর্থ বুধবার সবাইকে কাজ শেখানোর জন্য সময় দেন সুকিমি। সঙ্গে করে অবশ্যই নিজস্ব সেলাই করার সরঞ্জাম এবং কাপড় নিয়ে আসতে হবে। এ কাজ শেখানোর সময় সুকিমি জানান পুতুল বানাতে কী কী জিনিস ব্যবহার করেছেন তিনি। যেমন পুতুলের প্রথম স্তরের জন্য কেমন কাঠ, মাথার জন্য কী ধরনের তুলা, চামড়ার জন্য কেমন নমনীয় কাপড়, চোখের জন্য কেমন বোতাম, প্রতি পুতুলের দেহ বানাতে কতগুলো তার ও কী ধরনের ৮০ রোল কাগজ লাগে এসবের ব্যবহার সুকিমি দেখান হাতে-কলমে।

ছবিঃ সংগৃহীত

পুতুলের গায়ে যে কাপড় জড়ানো হয়, সেগুলো সাধারণত পুরনো হয়। এই কাপড়গুলো সুকিমি জোগাড় করেন জাপানের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া দান করা কাপড় থেকে। এ ছাড়া যারা আগে গ্রামে বাস করতেন, তাদের ব্যবহার করা কাপড়গুলোও ব্যবহার করা হয়। নাগোরো গ্রামের প্রতি বাড়ির অন্তত একজনের করে হলেও পুতুল বানিয়েছেন সুকিমি।

প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম রবিবার পুতুল নিয়ে বার্ষিক একটি আয়োজনও করা হয়। সাত বছর ধরে এ আয়োজন করা হচ্ছে। নানা দেশের পর্যটকের কাছে এই আয়োজনটি বেশ পছন্দের। এ ছাড়া সুকিমির বাড়িতে কেউ যদি বেড়াতে যেতে চান, কখনোই নিষেধ করেন না তিনি। সুকিমির বাড়িতে গেলে দেখা মিলবে তার মায়ের। উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে তিনি বসারঘরে বসে থাকেন সব সময়। সুকিমি রোজ তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। শুধু পার্থক্য, সুকিমির কথার কোনো জবাব মা দেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top