পৃথিবীতে কেন ডার্ক ম্যাটার নেই?

মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের মতো। অথচ মাত্র গত ২০০ বছরের বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টায় আমরা এর অনেকটাই বুঝে গেছি। দেখা গেছে, মোটা দাগে মহাবিশ্বে আছে কেবল দুই ধরনের জিনিস। পদার্থ ও শক্তি। পদার্থের কণাগুলোকে এনরিকো ফার্মির নামানুসারে বলা হয় ফার্মিয়ন আর, শক্তির কণাগুলোকে সত্যেন বোসের নামানুসারে বলা হয় বোসন।

প্রথমে ফার্মিয়ন, মানে পদার্থদের কথা বলি। মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক পদার্থকে রসায়নবিদরা মাত্র ১ পৃষ্ঠায় বেঁধে ফেলেছেন। এর নাম পর্যায় সারণি। আর, পর্যায় সারণিতে যত পদার্থ আছে, মাত্র ৪টি মৌলিক কণা দিয়ে এদের সব কয়টাকে ব্যাখ্যা করা যায়। এরা হলো, ইলেকট্রন, আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন। (প্রাচীন গ্রিকরা ভাবতেন, আগুন, পানি, মাটি ও বায়ু-এই ৪টি জিনিস দিয়ে সব কিছু তৈরি। তাদের ধারণা ঠিক না হলেও, আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাও একইরকম সরল। মাত্র ৪টি কণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে আমাদের পরিচিত সব পদার্থকে। চমৎকার না?)

আমরা জানি, পদার্থের কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, আর একে ঘিরে থাকে ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। এই প্রোটন ও নিউট্রন মূলত আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্ক নামে দুটি ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। আর, এদেরকে একসাথে বেঁধে রাখে স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বা শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের কণা গ্লুওন। এই হলো, ৪ কণায় পর্যায় সারণির সব পদার্থের ব্যাখ্যা।

এখানে বলে রাখা দরকার, ফার্মিয়নরা আবার ২ ধরনের। কোয়ার্ক ও লেপটন। ওপরে আমরা ২ ধরনের কোয়ার্কের কথা জেনেছি। আপ ও ডাউন কোয়ার্ক। এছাড়াও আরো ৪ ধরনের কোয়ার্ক আছে মহাবিশ্বে। টপ, বটম, চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ। সব মিলিয়ে কোয়ার্ক মোট ৬ ধরনের।

আর, ওপরে একটি লেপটনের কথাও জেনেছি আমরা-ইলেকট্রন। এছাড়াও মিউওন, টাউ, নিউট্রিনো ইত্যাদি লেপটন আছে।

এসব ছাড়াও, ওপরে বলবাহী একটি বোসনের কথা জেনেছি আমরা। গ্লুওন। আমাদের অতিপরিচিত আলোর কণা ফোটনও এক ধরনের বোসন।

আরেকটি বিখ্যাত বোসন হচ্ছে হিগস বোসন। হিগস-ফিল্ডে কোনো পদার্থের কণা চলতে গিয়ে যখন বাধা পায়, তখন সেখানে যে ‘অ্যানোমেলি’ বা ঝামেলা দেখা দেয়, তাই বস্তুর ভর। আর, এই হিগস-ফিল্ডের কণার নাম হিগস বোসন। বস্তুর ভরকে তাই সরলভাবে বলা হয়, হিগস-কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফল।

মোট ৬ ধরনের কোয়ার্ক, ৬ ধরনের লেপটন ও ৫ ধরনের বোসন কণা নিয়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের হাউস অব কার্ডস-স্ট্যান্ডার্ড মডেল। আমরা এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বে যা কিছু ব্যাখ্যা করতে পারি, এর সবকিছুই আছে এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আওতায়।

অথচ, মহাবিশ্বের মাত্র ৫% এর মতো পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা দিতে পারে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। বাকি ৯৫% জিনিসের কোনো ব্যাখ্যাই সে দিতে পারে না। এরমধ্যে ২৭% হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার এবং ৬৮% হচ্ছে ডার্ক এনার্জি।

নাম শুনে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি মোটেও আলোকে গিলে বা শুষে নেয় না। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, আলো শুষে নেয়, এমন বস্তুকে বোঝাতে ইংরেজি ‘ব্ল্যাক’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। যেমন, ব্ল্যাকবডি বা ব্ল্যাকহোল। আর ‘ডার্ক’ কথাটা দিয়ে বোঝায়, এরা যে কী, এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই!

এর একাধিক বাংলা করা হয়েছে। কেউ কেউ ডার্কের বাংলা করেছেন ‘তমো’। যেমন, ডার্ক ম্যাটার মানে তমোবস্তু। তমো কথাটার অর্থ নিকষ, ইংরেজি ডার্কের সঙ্গে যে বাংলাটা বেশ খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু ‘ডার্ক’ ম্যাটার বলতে যা বোঝানো হয়, সেই অর্থের সঙ্গে দূরত্বটা থেকেই যায়। আমি তাই অন্য আরেকটি বাংলাকে বেশি যৌক্তিক মনে করি, ‘গুপ্ত’, যেমন, গুপ্তবস্তু। আসলে ডার্ক ম্যাটার তা-ই। এমন এক বস্তু, যা লুকিয়ে আছে আমাদের জ্ঞানের অন্তরালে। ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই।

ডার্ক ম্যাটার আছে, সেটা বিজ্ঞানীরা কীভাবে বুঝলেন বা এদেরকে কীভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে-এগুলো এ লেখার আলোচ্য বিষয় না। তবু, সংক্ষেপে ব্যাপারটা একটু না বলে নিলে ভুল হবে।

আমরা জানি, মহাকর্ষ তৈরি হয় ভর থেকে। কোনো বস্তুর ভর যত বেশি, তার আকর্ষণ তত বেশি। আর, এই আকর্ষণ-ই হলো মহাকর্ষ।

মিল্কিওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডাসহ অন্যান্য গ্যালাক্সিগুলোর ভরের হিসাব করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, এই গ্যালাক্সিগুলোতে যে পরিমাণ ভর পাওয়া যাচ্ছে, এদের মহাকর্ষের পরিমাণ তারচেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ভর না থাকলে মহাকর্ষ কোত্থেকে আসবে? যৌক্তিকভাবে তাই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, গ্যালাক্সিগুলোতে গুপ্ত কোনো বস্তু আছে, যাদের কারণেই তৈরি হচ্ছে এই বাড়তি মহাকর্ষ। কিন্তু এই গুপ্তবস্তুরা মহাকর্ষ ছাড়া আর কোনোকিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না। সেটা হোক তড়িৎচৌম্বক বল কিংবা সবল বা দুর্বল নিউক্লিয়ার বল।

এখন আমাদের আলোচ্য প্রশ্নে আসা যাক। পৃথিবীও তো পদার্থ দিয়ে তৈরি। অনেক পদার্থ মহাকর্ষের ফলে একসঙ্গে হয়ে তৈরি হয়েছে সৌরজগৎ ও পৃথিবী। তাহলে, গ্যালাক্সির বেলায় যা হচ্ছে, পৃথিবীর বেলায় তা হচ্ছে না কেন? কেন পৃথিবীতে সাধারণ পদার্থের সঙ্গে গুপ্তবস্তু নেই? কেন পৃথিবীর মহাকর্ষের পুরোটাই এর সাধারণ ভর থেকেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে, গুপ্তবস্তুর প্রয়োজন হচ্ছে না?

এটার ব্যাখ্যাটা বেশ মজার। ধরা যাক, পৃথিবীর পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে একটা কণা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। ধরে নিই, বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে এর কোনো সংঘর্ষ হয়নি (মানে, কণাটা বায়ুমণ্ডলেই ধ্বংস হয়ে যায়নি)। মহাকর্ষের অমোঘ আকর্ষণে ছুটে আসছে পৃথিবী পৃষ্ঠের দিকে। যেই মুহূর্তে কণাটা পৃথিবীপৃষ্ঠে এসে পড়বে, তড়িৎচৌম্বক বল কণাটাকে থেমে যেতে বাধ্য করবে। ফলে কণাটা পৃথিবীর একটা অংশ হয়ে যাবে।

কিন্তু কণাটার ওপর যদি তড়িৎচৌম্বক বল কাজ না করে, তাহলে কী হবে?

ধরে নেই, গুপ্তবস্তুর একটা কণা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে। এর প্রাথমিক কিছুটা বেগ ছিল (যে বেগে সে পৃথিবীর দিকে আসছিল)। যেই মুহূর্তে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় পরিমণ্ডলের আওতায় চলে আসবে, কণাটার ত্বরণ হবে। আরো জোরে, আরো জোরে সে ছুটে আসবে পৃথিবীর দিকে। কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। যেহেতু বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল তার ওপর কাজ করছে না। এভাবে, ত্বরিত হতে হতে পৃথিবীর কেন্দ্র পেরিয়ে যাওয়ার পরে কণাটার মন্দন শুরু হবে। অর্থাৎ ত্বরণ কমতে থাকবে (সেই সঙ্গে বেগও)। তারপর, একসময় কণাটা পৃথিবীর মহাকর্ষীয় পরিমণ্ডল পেরিয়ে যাবে। ছুটতে থাকবে সেই প্রাথমিক বেগে (পৃথিবীর মহাকর্ষের টানে ত্বরণ হওয়ার আগে যে বেগে সে পৃথিবীর দিকে আসছিল)।

ঠিক এ কারণেই পৃথিবীতে গুপ্তবস্তুর কণা নেই। উঁহু, কথাটা পুরোপুরি ঠিক হলো না। আছে, সামান্য! পৃথিবীর মহাকর্ষের যে পরিমাণ, সেই তুলনায় পৃথিবীর ভর সামান্য কম। অল্প কয়েক গ্রাম ডার্ক ম্যাটার আছে পৃথিবীতেও! কীভাবে?

এমনই প্রাথমিক বেগ নিয়ে গুপ্তবস্তুর সেই কণাগুলো এসেছিল, যারা কোনোভাবে থমকে গেছে পৃথিবীর ভেতরেই। অবশ্যই, এই থমকে যাওয়ার পেছনে দায়ী ছিল পৃথিবীর মহাকর্ষ। একদম সুনির্দিষ্ট পরিমাণ বেগ নিয়েই এসেছিল তারা। এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু একেবারে শূন্য না। সেটাই হয়েছে!

হ্যাঁ, আমাদের পায়ের তলায়ও আছে খানিকটা ডার্ক ম্যাটার! কিন্তু এই গুপ্তবস্তুর দল কবে যে বিজ্ঞানীদের যান্ত্রিক চিলের চোখে (মানে, ডার্ক ম্যাটার ডিটেক্টরগুলোতে) ধরা দেবে, কে জানে?

আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে শেষ করি। ডার্ক ম্যাটারের মতো অপ্রমাণিত বিষয় নিয়ে এত হইহল্লা কেন? মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কথা আঁচ করেছিল আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। তারও প্রায় ১০০ বছর পরে এসে শনাক্ত করা গেছে এই তরঙ্গের অস্তিত্ব। ব্ল্যাকহোল আছে, যার ভেতরে কাজ করে না আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব, ভেঙে পড়ে আমাদের জানা সমস্ত জ্ঞান। কোথায় সেই ব্ল্যাকহোল? এতদিন অনেকেই ভেবেছেন এমনটা। কল্পনাকেও হার মানিয়ে মানুষ সেই ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলে ফেলেছে!

চিন্তা করুন, যান্ত্রিক চিলের চোখে যেদিন ধরা পড়বে গুপ্তবস্তু, যদি ধরা পড়ে আরকি-সেদিন যদি আপনি বেঁচে থাকেন, কেমন লাগবে আপনার? কেমন লাগবে এটা ভেবে যে, ৫ শতাংশ থেকে মহাবিশ্বের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান এক লাফে পৌঁছে গেছে ৩২ শতাংশে?

স্বয়ং মহাবিশ্বের রহস্য ভেদ করার পথে আমাদের এই যে পথচলা, এর যে রোমাঞ্চ-এর আসলে কোনো তুলনা হয় না।

সূত্র: ডার্ক ম্যাটার অ্যান্ড ডার্ক এনার্জি : দ্য হিডেন ৯৫% অব দ্য ইউনিভার্স, ব্রায়ান ক্লেগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top