জীবন কি কেবলই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর ক্যারিয়ারের জন্য

শৈশব থেকেই অসুস্থ এ সমাজের কঠিন প্রতিযাগিতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে কোমলমতি সন্তানদের বাধ্য করা হয় এ সমাজে। আধুনিক অভিভাবকেরা জীবনে যে মনোবাসনা পূরণ করতে পারেননি, সন্তানদের দিয়ে সেটি বাস্তবায়নের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামের দল বেঁধে। প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফল ‘এ প্লাস’ না হলে যেন অভিভাবকত্বের মানহানি ঘটে। অধিকাংশ শিশুর কাছে দাদুবাড়ির মানুষ যেন বড্ড অচেনা। গাঁয়ের কাদামাখা মানুষের সঙ্গে মিশলে শিশুরা পথভ্রষ্ট হতে পারে ভেবে এ যুগের শিক্ষিত মায়েরা কখনোই তাঁদের (গাঁয়ের আত্মীয়দের) আদর-স্নেহকে খুব বেশি প্রশ্রয় দিতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে আদিখ্যেতা ভেবে এড়িয়ে চলেন। সভ্য-শিক্ষিত (পাষাণ) মা-বাবাদের একটাই লক্ষ্য—সন্তানদের ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে, পড়তে হবে এবং ভালো রেজাল্ট করতে হবে!

শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ শিক্ষক নামক জাতির বিবেকেরা! নীতিপ্রণেতারা চুপটি মেরে থাকবেন কেন…? তাঁরা তো প্রতি বছর সিলেবাস পরিবর্তন করেই চলেছেন, কোচিং বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন, কালেভদ্রে বিদ্যালয় তথা শিক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন, শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল সামগ্রী অনুদান দিচ্ছেন, আরও কত কী…! পক্ষান্তরে প্রাইভেট–পাবলিক (সরকারি নয় এমন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিবছর, কখনো দুবারও বেতন বৃদ্ধি করছে। একই শিক্ষক বিদ্যালয়ে সাধারণ মানের শিক্ষাদান করেন, তাঁরাই আবার প্রাইভেটে বা কোচিং–বাণিজ্যে অ-সাধারণ বণিক বনে যান। সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষকের যশখ্যাতির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই…। অতএব, এবার কোচিং–বাণিজ্যে খদ্দের না হয়ে কি উপায় আছে…? কোচিং বিপণনের চাহিদা এতটাই তুঙ্গে যে আগে এলে আগে আসন বরাদ্দ পাবে, নয়তো…অকারণেই ভুল বলে বিবেচিত হবে অসহায় ছাত্রের পরীক্ষার উত্তরপত্রগুলো।

সরকারি তৎপরতায় ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’গুলোতে ইতিমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে—শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধিসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সরকারি তৎপরতা ইত্যাদি। মজার ব্যপার হচ্ছে, ওই বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে, তবে কি ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের সুপ্রভাব? তাহলে সরকারের এ পদক্ষেপগুলো কাদের জন্য? পক্ষান্তরে, শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়…!

অবচেতন মনেই ডিজিটাল অভিভাবকেরা স্বপ্নের জাল বোনেন এভাবে—নিশ্চয়ই তাঁদের সন্তানেরা একদিন অনেক বড় অফিসার হবে, আর সেদিনই সার্থক হবে তাঁদের জন্মদান! অপর দিকে আমরা আশঙ্কায় আছি সেদিনের জন্য, যেদিন তারা অনেক বড় অফিসার হবে বটে! বড় বড় অট্টালিকার মালিক হবে, কিন্তু মা-বাবার জন্য এতটুকু আশ্রয়স্থল থাকবে তো? অবচেতন মনেই প্রশ্ন জাগে, তারা কর্মজীবনে অনেক বেশি প্রথিতযশা মানুষ হওয়ার কারণে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে না তো? শ্রদ্ধাভাজনেষু জন্মদাতা মা-বাবার সেবা করার জন্য এতটুকু সময় থাকবে তো? নাকি নিশ্চিন্ত মনে তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবে?

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষে একটি মূল্যবান সনদ পেলেই বুঝি প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়? জীবনমুখী মানবিক শিক্ষার প্রয়োজন কি নেই এতটুকু? কে শেখাবে? কোথায় আছে ওই সব প্রতিষ্ঠান? অনেক বড় ডিগ্রি অর্জিত হলেই জনৈক শিক্ষার্থীর মনে দাঁনা বাঁধতে থাকে নতুন নতুন স্বপ্ন! স্বয়ং পরিবারের নিকটজন ও এ সমাজের উচ্চাভিলাষী মানুষেরা স্বপ্নে বিভোর হয়ে যান। ক্যারিয়ার গঠনের প্রতিযোগিতায় কেউ রাতারাতি বড় অফিসার, কেউ স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, কেউবা প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতা বনে যায়! অন্যদিকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ছাত্রজীবনের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিও শেষমেশ ছিটকে পড়ে এ প্রতিযোগিতায়, কে রাখে তার খবর!

শুধু জীবিকায়নই নয়; বরং যশখ্যাতি, ক্ষমতা, প্রভাব বিস্তার, তথা ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করতেই নিদেনপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের সন্তানেরাও পাড়ি জমায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে! খাওয়া নেই নাওয়া নেই, স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিবিড় নৈকট্যে কাটানোর মতো এতটুকু সময়ও যেন অবশিষ্ট নেই! শুধু ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ার আর ক্যারিয়ার! সময়ের খেরোখাতায় সন্তানেরা শারীরিকভাবে বেড়ে উঠতে থাকে, সময়ান্তে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ডিগ্রিও অর্জন করে! কিন্তু কোথায় যেন অবচেতনভাবেই একটি বড় অভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। সন্তানেরা কি আদৌ পারিবারিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে? মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্তের বদনামটি হয়তো ঘুচে যাবে কোনো এক সময়, সফল ক্যারিয়ারের বদৌলতে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে হয়তো আট ডিজিট–সমৃদ্ধ প্রচুর টাকাও জমে থাকবে! চারদিকে ‘সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি’ হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়বে! তবু একটি অদৃশ্য অভাব যেন সেদিন কুরে কুরে খাবে! ভালোবাসার অভাব! স্ত্রী-সন্তানদের কাছে না পাওয়ার অভাব! মধ্য বয়সে অথবা শেষ বয়সে শৈশব-কৈশোরের সেই দিনগুলো নতুন করে ভিড় জমাবে অবচেতন মনে!
শুধু ক্যারিয়ার–সমৃদ্ধ হতে গিয়েই আমরা জীবনকে প্রকৃতভাবে উপভোগ করতে ভুলে যাই! গাঁয়ের মেঠো পথের আবেগঘন স্মৃতিকে খুব সহজেই গলা টিপে হত্যা করে ফেলি সহজেই। প্রিয়জনদের ‘না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার’ খবর শুনেও এতটুকু আঁতকে উঠি না আবেগপ্রবণ মানুষ হয়ে। ক্যারিয়ারে বিভোর হয়ে বৃদ্ধ মা-বাবার পাশে থাকার কারও এতটুকু সময় থাকে না! মাসে মাসে প্রচুর টাকা, ডলার কিংবা ইউরো পেলেই কি মা-বাবার অভাব ঘুচে যায়? টেলিফোনে কিংবা ভিডিও কলে কথা বলে কি প্রাণের আকুতি মেটানো সম্ভব হয় পুরোপুরি? বরং ভালোবাসার তীব্রতা, কাছে না পাওয়ার আকাঙ্খাটি কি দ্বিগুণ বেড়ে যায় না তখন? কী আর করার? ক্যারিয়ার–সমৃদ্ধ মানুষের মা-বাবাদের কিই–বা করার থাকে তখন? প্রকৃতির নিয়মে বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যান মা-বাবা। একসময় ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অনেক অভিমান সঙ্গে নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তাঁরা। সন্তানদের ক্যারিয়ারে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, এ জন্য না বলা কষ্টগুলো আর কখনোই প্রকাশিত হয় না! কষ্টগুলোও যেন মেঘরাশির সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়!

জীবনসায়াহ্নে প্রথিতযশা ওই ক্যারিয়ার–সফল মানুষগুলো সূদুর অতীতে ফিরে যান মুহূর্তেই! হৃদয়ের গভীর থেকে হু হু করে অস্পষ্ট চাপা কান্না বেরিয়ে আসতে চায়! ক্যারিয়ার অভিলাষী এ সমাজে ওই চাপা কান্না শোনার মানুষের বড্ড অভাব! শুধু ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে থাকা মানুষগুলো প্রকৃতপক্ষে বড্ড অভাবী! হতভাগ্যের চাদর গায়ে জড়িয়ে শেষ জীবনে তাঁরা পালিয়ে বেড়ান! কখনো আবার বিবেকের আত্মদংশনে নীল হয়ে যান। ভালোবাসাবঞ্চিত ওই মানুষগুলোকে দেখে যতটাই সুখী-সম্পদশালী মনে হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের মতো দুঃখী আর ভালোবাসার কাঙাল কেই–বা হতে পারেন? হে সুশীল সমাজের কর্ণধার, আমরা কি তবে মা-মাটি-দেশকে ভুলে ক্যারিয়ার গঠনেই নিজেকে ব্রত করব? আজ তবে জেগে উঠুন সর্বাগ্রে ‘মানুষ হওয়ার জন্য, মানুষ বানানোর মিছিলে’। কেবল জীবনের জন্যই হোক ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ারের জন্য জীবনের বর্ণিল সৌন্দর্য হারিয়ে না যাক। ক্যারিয়ার–সমৃদ্ধ হওয়ার আগে আমাদের উচিত, ‘ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা’। আর তাহলেই সমাজের সব জঞ্জাল ধূলিসাৎ করে আগামী প্রজন্ম আপনার, আমার, আমাদের এ সমাজকে সাজাবে নতুন করে, শান্তিময় করে…!

*লেখক: মো. তানজিমুল ইসলাম, অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ (প্রথম আলো)

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top