বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি

প্রথমত একটা কথা বলতে চাই – “সাকসেস হ্যাজ নো শর্টকাট”, কেউ একজন এক সপ্তাহ পড়ে প্রিলিমিনারি পাশ করে গিয়েছেন এরকম গল্প অনেকের মুখে শুনলেও বাস্তবে সেই লোকটির সাক্ষাৎ খুব কমই পাওয়া যাবে। তবে হ্যাঁ, অল্প সময়ের প্রস্তুতি নিয়েও যে কারো কারো সফলতা আসেনি তা কিন্তু না, কেননা প্রিলিটা যতখানি না প্রস্তুতির তার থেকেও কিছুটা বেশি আমি বলব যে ভাগ্যের প্রসন্নতা। যাই হোক কাজের কথায় চলে আসি। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে যে প্রস্তুতিগুলো আপনাদেরকে নিতে উৎসাহিত করবো তা হলো:

১। প্রশ্ন ব্যাংক সমাধান করা

এটি অবশ্যই করতে হবে, শুধু উত্তর না, ব্যাখ্যাসহ সবগুলো উত্তর ভালো করে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে আমি দুটি বই অনুসরণ করেছিলাম– অ্যাসিওরেন্স এবং প্রফেসর’স (২ বছরে ২টা কিনেছিলাম)। সমাধান করা প্রশ্নগুলো প্র্যাকটিস করার জন্য আমি প্লে স্টোর থেকে বিসিএস এর কিছু অ্যাপ্লিকেশন নামিয়ে রেখেছিলাম, অবসর সময়গুলোতে সেই অ্যাপগুলোতে পরীক্ষা দিতাম। যে উত্তরগুলো ভুল হতো সেগুলো বাসায় গিয়ে বই থেকে আবার ব্যাখ্যাসহ দেখে নিতাম।

২। বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি

২-১। বাংলা

ক। ড. সৌমিত্র শেখরের “বাংলা প্রশ্নের টীকা-ভাষ্য” নামে একটা বই ছিলো। ১২০০ এর উপরে টিকা ছিলো ব্যাখ্যাসহ, যেটা শেষ করতে আমার সময় কম লেগেছিলো এবং শেষ করার পরে কিছুটা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলাম নিজের মধ্যে। একটি কথা বলে রাখি এখানে, বই এর সাইজ যতো ছোটোই হোকনা কেনো, পুরো বই শেষ করতে পারার মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ইতিবাচকভাব কাজ করে, যা আমাকে অন্য আর একটি বই শেষ করার পেছনে অনুপ্রেরণা দিতো।

খ। সিলেবাস অনুযায়ী “৯ম-১০ম শ্রেণীর বাংলা বোর্ড ব্যাকরণ” বইটি পড়েছি, এখানকার সব টপিক পড়তে হবে না, শুধু যে টপিকগুলো থেকে আগের বছরগুলোতে প্রশ্ন হয়েছে সেগুলো দেখলেই হবে।

গ। মহসিনা নাজিলার “শীকর বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য” বইটি এখন ভালো করেছে, সৌমিত্র শেখরের টিকা ভাষ্য-এর থেকে এটি কলেবরে বড়, তবে অনেক তথ্যবহুল এবং সহজে পাঠ উপযোগী একটি বই।

২-২। ইংরেজি

ক। “English for Competitive Exam”- এটি থেকে ভালো বই পাওয়া কষ্টকর ছিলো, কিন্তু বইটি অনেক বড়, শেষ করার মতো সুযোগ হয়ে উঠেনি, তবে এর থেকে বেছে বেছে অনেকগুলো টপিকস পড়েছি, যেগুলো বেশ উপকারে দিয়েছে।

খ। “A Handbook on English Literature” এবং “An Easy Approach to English Literature For BCS Preliminary” বই দুটো ইতিহাস অংশের জন্য খুবই ভালো কাজে দিয়েছে, তবে কেনার আগে অবশ্যই দেখে নিতে হবে আপডেটেড প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যাসহ উত্তর দেওয়া আছে কী না।

২-৩। দৈনন্দিন বিজ্ঞান

আমি মূলত “MP3 দৈনন্দিন বিজ্ঞান” বইটিই পড়েছি তবে ইউটিউবের বিজ্ঞানের বেশকিছু ভিডিও আছে যেগুলো আমাকে সাহায্য করেছিলো। পড়তে পড়তে যখন বিরক্ত লাগতো তখন একটি-দুটি গান শোনা বা সেগুলোর ভিডিও দেখার পর এই ভিডিওগুলো দেখতাম, বিশ্রামও হতো আবার পড়াও হয়ে যেতো, তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে তথ্যের ভুলের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে।

২-৪। কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি

বিএসসি টা সিএসই-তে হওয়াতে এটি আমার জন্য কিছুটা সহজ ছিলো, তবে এক্ষেত্রে MP3 এর কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বইটি পড়েছি।

২-৫। মানসিক দক্ষতা

প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষার জন্য একবারেই কাজে দেয় এই বইগুলো। আমি অ্যাসিওরেন্স মানসিক দক্ষতা বইটি পড়েছি, তবে এক্ষেত্রে যারা আগে ডিফেন্সের আই.এস.এস.বি-এর প্রথম দিনটি পার করেছেন, তারা খুব সহজেই আগের প্রস্তুতি দিয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকতে পারবেন, তা নাহলেও খুব একটা সমস্যা হবে না, এই বিষয়টা তুলনামূলক সহজ এবং একটু মাথা খাটিয়ে পড়লে ভালো নম্বর পাওয়া সম্ভব।

২-৬। অংক

ক। “MP3 Math Review” বইটা পড়েছি

খ। নীলক্ষেতে কিছু ম্যাথ শর্টকাটের বই খুঁজে পেয়েছিলাম, যেটা তাড়াতাড়ি উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে, তবে এ মুহূর্তে নামগুলো ঠিক মনে পড়ছে না।

গ। রবি ১০ মিনিট স্কুলস এর ম্যাথ টিপিস ভিডিওগুলো অবসরে অবশ্যই দেখবেন, এগুলো আমার বেশ কাজে দিয়েছিলো।

বলে রাখা ভালো, যারা ম্যাথে দুর্বল, শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে কখনই আগে ম্যাথে হাত দিয়ে নিজেকে হতাশ করবেন না।

২-৭। বাংলাদেশ

ক। MP3 বাংলাদেশ বইটা পড়েছিলাম

খ। প্রতিদিন একটি খবরের কাগজে বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক এই দুটো বিভাগ পড়তে পারলে তা আপনাকে প্রিলি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে উপকার দেবে।

২-৮। আন্তর্জাতিক

ক। MP3 আন্তর্জাতিক বইটা পড়েছিলাম

খ। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে এই দিকটা সব সময়ই বিপদের, এজন্য বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক এই দুটোর জন্য আর একটা কাজ আমি করতাম। মডেল টেস্টের তিনটি বই আমার ছিলো, সেগুলোতে এই সেকশনের প্রশ্নগুলো বারবার দেখতাম।

২-৯। ভূগোল: অ্যাসিওরেন্স

২-১০। নৈতিকতা: অ্যাসিওরেন্স

৩। নিজেকে যাচাই করা

ক। ৩৭-এর প্রস্তুতির শুরু থেকেই আমি চেষ্টা করতাম সপ্তাহে ৩/৪ টা মডেল টেস্ট দিয়ে নিজের প্রস্তুতিটা যাচাই করার, এক্ষেত্রে আমি শুধু সঠিক দাগানোর অভ্যাস করতাম, শুরুতে যেটা ২৫-৩০ দিয়ে শুরু হয়েছিল সেটা শেষ পর্যন্ত ১৪০-১৫০ সঠিক দাগানোতে আনতে পেরেছিলাম।

খ। প্রিলির একমাস আগে থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিটে একটা করে মডেল টেস্ট দিতাম। আমার তিনটা বই ছিলো অ্যাসিওরেন্স, প্রফেসর’স, জ্ঞানদ্বিপ এর।

এছাড়াও, ডাইজেস্ট ছিলো অ্যাসিওরেন্স-এর। তবে শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে- “প্রফেসর’স এর বিশেষ সংখ্যাটা” শেষ করেছিলাম, খুবই সহায়ক ছিলো বইটা।

আমার ব্যাপারে কিছু প্রশ্নের উত্তর

১। এটি আমার তৃতীয় প্রিলি পরীক্ষা ছিলো – ৩৫, ৩৬, ৩৭ (শুধুমাত্র এটাতেই পাশ করেছি)

২। প্রিলির জন্য কোন কোচিং করতে পারিনি, সুযোগ থাকলে হয়ত করতাম, তবে লিখিত পরীক্ষার জন্য কোচিং করেছিলাম।

৩। ২০০৯ থেকে চাকরি করছি, তাই এটি ছেড়ে দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার মতো ইচ্ছা থাকলেও, আর্থিক টানাপোড়ন দেখা দিলে মানসিকভাবে চাপে পড়ে যেতে পারি ভেবে আর সে পথে আগাইনি। তবে হ্যাঁ ৩৭ মাসের দীর্ঘ পথ চলার মধ্যে মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটে থাকে। তাই চাকরির পাশাপাশি প্রস্তুতি নিতে পাড়লে সেটি সব থেকে উত্তম (যদি চাকরির পরিবেশটা ভালো হয় তবে)।

৪। যেভাবে পড়তাম

ক। ৯-৬ টা অফিসের পর বাসায় এসে (বাসা অফিসের খুব কাছে ছিলো) দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে রাত ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করতাম। একদিন ২ ঘণ্টা, অন্যদিন ৮ ঘণ্টা এভাবে পড়াটা আমার পছন্দ ছিলো না, সবাইকে আমি এটাই বলি যেটাই করবেন একইভাবে চালিয়ে যাবেন (অন্তত ৩ থেকে ৪ মাস), তাহলে অবশ্যই সেটির ইতিবাচক ফলাফল আপনি দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ।

খ। কালো কালির বই লাল বা নীল কালির কলম অথবা হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করে রাখতাম

গ। একই টপিকস টানা না পড়ে, প্রতি সাবজেক্টের সর্বাধিক ১৫-২০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়তাম একটানা – উল্লেখ্য, মুখস্থবিদ্যায় আমি খুব ভালো না হওয়ার কারণে আমি মুখস্থ করবার জন্য ব্রেনের উপর চাপ না দিয়ে, যে বিষয়গুলো মনে রাখতে কষ্ট হতো সেগুলো ২/৩ দিন পরপরই রিডিং পড়ার মতো করে দেখতাম, সব না, শুধুমাত্র হাইলাইট করা অংশগুলো।

ঘ। বিজ্ঞান এবং সিএসই ব্যাকগ্রাউন্ডের হওয়ার কারণে – বিজ্ঞান, আইসিটি, অংক, মানসিক দক্ষতা এগুলোর নম্বর যতোটা বাড়ানো যায় সে লক্ষ্য আমার সবসময় ছিলো। এখানে একটা ব্যাপার আছে, পুরনো প্রশ্নগুলো এক্সাটলি রিপিট না হলেও সেম প্যার্টানের প্রশ্ন অনেক আসে, এছাড়াও ঐ বছরের বিভিন্ন সরকারি পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে প্রশ্নগুলোর অনেক মিল পাওয়া যায় (বিষয়টা কাকতালীয় না, আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমি এমন মিল খুঁজে পেয়েছি)।

ঙ। শেষ যে কাজটা আমি করতাম তা হলো – ৩৫ এর পর কোন প্রিলিই আমি ঢাকাতে দিতাম না। কেননা, খুলনায় আমাদের বাসা, সেখানকার সুবিধাগুলো হলো সেখানে যানজট নেই। হলের পরিবেশ যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি পেয়েছি। আর লিখিত পরীক্ষা বিগত ৪/৫ টা বিসিএস একই সেন্টারে হচ্ছে। যেটি আমার বাসা থেকে ১০ মিনিটের পথ মাত্র। যাদের যানজট এড়ানোর এই সুযোগটা রয়েছে তারা তা অবশ্যই নিতে পারেন।

পরিশেষে এটিই বলব, বিসিএস একটি স্বপ্নের নাম, এই চলার পথটা যেমন অনেক দীর্ঘ, তেমনি এই পথে প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে অনেক, আপনার পথের প্রতিবন্ধকতাগুলোকে আপনার নিজের কৌশলেই অতিক্রম করতে হবে, অন্যের দেখানো পথটিই যে আপনাকে অনুসরণ করে চলতে হবে ব্যাপারটি কখনই এমন নয়, বরং আমি মনে করি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো যাদের একমাত্র লক্ষ্য তারা নিজেরাই তাদের কৌশল ঠিক বের করে নিতে পারেন।

লেখক: মো. মাসুদুর রহমান, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৩৭ তম বিসিএস

সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top