ক্রীতদাস হয়েও দাসদের মুক্তি দিয়েছিলেন যিনি

বর্তমানের অনেক উন্নত দেশগুলোতেই আগে প্রচলিত ছিল দাস প্রথা। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করা হত। শুধু যে দাস হিসেবেই ব্যবহার করা হত তা না, এদের কপালে জুটতো অমানবিক শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার। সেই সাথে বর্ণ বৈষম্য, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, অবহেলা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়।

এই দাসদের মধ্যেই একজন ছিলেন হ্যারিয়েট তুবমান। যিনি শুধু নিজের নয়, কয়েকশ ক্রীতদাসের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। সেও এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন ভূগর্ভস্থ রেলপথের প্রদর্শক। কীভাবে তার জীবনের এই পরিবর্তন সেসবই জানাবো আজ। এমনই পৃথিবীর ইতিহাসের কালজয়ী আর দিক পরিবর্তনকারী সাহসী নারীদের কথা জানতে ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকুন।

হ্যারিয়েট তুবমান ১৮২০ সালে মেরিল্যান্ডের পূর্ব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে বেশিরভাগ ক্রীতদাসদের মতোই জন্মতারিখ মনে রাখেননি তিনিও। কেননা এমন এক জায়গায় তার জন্ম, যেখানে সবার ভবিষ্যত লেখা হয়ে যায় জন্মের আগেই। এখানকার মানুষদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত দাসত্ব। তিনি সেখানে অ্যারিমান্টা রস নামে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তার আরেকটি নাম ছিল মন্টি রোজ।

প্রথা অনুযায়ী তিনি অল্প বয়সেই এক শ্বেতাঙ্গ পরিবারে দাসী বনে যান। সেখানে তাকে রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হত। শস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাড়ির কাজ, ছোট শিশুদের দেখাশোনা সবই করতে হত তাকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই। তার মালিকের মৃত্যুর পর তাকে অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। আগের মালিকের ছেলেই তাকে বিক্রি করে দেয়। নতুন মালিক কিছুটা ভালো ছিলেন। তার কাজের বেশ প্রশংসা করতেন। এমনকি বকশিসও দিতেন মাঝে মাঝে। সেই অর্থ মন্টি রোজ জমিয়ে রাখতেন নিজের কাছে। ১৮৪৪ সালে তিনি বিয়ে করেন জন তুবমান নামের এক ব্যক্তিকে। এরপর তার নাম হয় হ্যারিয়েট তুবমান।  

সারাজীবন হ্যারিয়েট তুবমান দাসত্বই করে গেছেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তুবমানের ছিল না। তবে তিনি বাইবেল সম্পর্কে কিছুটা জানতেন। পড়তে না পারলেও শুনে শুনেই বাইবেলের অনেক কিছু তিনি মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তুবমান ভেষজ নানা রকম ওষুধ তৈরি করতে পারতেন। যা ভবিষ্যতে তার খুব কাজে লেগেছে। কঠোর পরিশ্রম করার কারণে অল্প বয়সেই তুবমানের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গিয়েছিল। যৌবনে তুবমান একবার গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। তার মালিক একবার আরেকজন দাসকে শাস্তি দেয়ার জন্য একটি সীসার ভাড়ি বস্তু তার উপর ফেলে। তবে তুবমান পাশে থাকায় তার মাথায়ও ওই বস্তুর আঘাত লাগে। প্রাণে বেঁচে গেলেও সারা জীবন এর জন্য অনেক ভুগেছেন তিনি। অল্পেই স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যেত তার, কোমায় চলে যেতেন তিনি।

১৮৪৯ সালে তিনি এই দাসত্বের জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেন। যদিও এই স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন অনেক আগেই, তবে সুযোগ আর সাহস পাচ্ছিলেন না। অবশেষে তিনি পালাতে সক্ষম হন। একদিন তিনি জানতে পারেন তার দুই ভাইকে দক্ষিণে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এদিকে তার স্বামীও তাকে বিক্রি করার কথা ভাবছে। সবকিছু জেনেই তিনি পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চাইছিলেন দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি। মেরিল্যান্ড থেকে পালিয়ে তিনি ডারউইলারের দিকে হাঁটতে থাকেন। একসময় এসে পৌঁছান ফিলাডেলফিয়া।

তুবমান ফিলাডেলফিয়ার ভূগর্ভস্থ রেলপথ (টানেল ) দিয়ে পালান। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে রান্নার কাজ পেয়ে যান তিনি। এতে তার জীবন স্বাধীন হয়। খুব আনন্দেই তিনি দিন কাটাচ্ছিলেন। এসময় তার মনে হলো তার কাছের মানুষদেরও তিনি এখানে নিয়ে আসবেন। যাতে সবাই দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় এবং খুব সন্দর একটি জীবন কাটাতে পারে। বছরখানেক পর মেরিল্যান্ডে আবারো ফিরে যান তুবমান। তার কিছু আত্মীয়দের তিনি ফিলাডেলফিয়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য তার সঙ্গে ফিলাডেলফিয়াতে যেতে রাজি হন।

এই সময়ের মধ্যে তুবমান ফিলাডেলফিয়া থেকে মেরিল্যান্ডে যাওয়ার জন্য একটি গোপন পথ তৈরি করেন। কারণ মেরিল্যান্ড ক্রীতদাস অঞ্চল। সেখানে গেলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তারপরে আবার যারা সেখান থেকে পালাতে চান তাদের জন্য দরকার একটি নিরাপদ পথ। সেজন্যই এই উপায় বের করেন তিনি। তুবমান যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন সঙ্গে বেশ কিছু বই রাখতেন। যাতে কেউ তাকে নিরক্ষর ক্রীতদাস মনে না করে। কেননা একজন দাসীর কাছে নিশ্চয় কোনো বই থাকবে না। একথা সহজেই সবাই বিশ্বাস করবে। এছাড়াও মাঝে মাঝে বৃদ্ধ এবং শারীরিকভাবে দুর্বল এমন নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করতেন তুবমান। 

১৮৫০ সালের পুরোটা সময় তিনি অল্প অল্প করে প্রায় কয়েকশ মানুষকে এভাবে কানাডায় নিয়ে আসেন। একসময় কানাডার সীমান্তজুড়ে মেরিল্যান্ড থেকে পালিয়ে আসা ক্রীতদাসদের বসতি গড়ে ওঠে। যেহেতু এই কাজের কোনো প্রমাণ বা ক্রীতদাসদের কোনো তালিকা করা হয়নি তাই সঠিকভাবে এর সংখ্যা বলা যায় না। তবে অনুমান করা যায় প্রায় ১৫ বারে তিনি ২০০ এর বেশি ক্রীতদাস মুক্ত করেছিলেন। এই পুরো সময়টায় তুবমান কানাডায় বসবাস করতেন। ধরা পরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল প্রতিবার। একসময় সরকার থেকে এই খবর জানার পর তুবমানকে ধরার চেষ্টা চালায়। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ঘোষণা করা হয় ১২ হাজার মার্কিন ডলার। এরপর তা বাড়িয়ে করা হয় ৪০ মার্কিন ডলার। তবে কেউই তাকে ধরিয়ে দেয়ার আগ্রহ দেখায়নি।

তবে কানাডায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ধরা পরেন তুবমান। তার সাহায্যে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসরাই আন্দোলন করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। যুদ্ধের পরে হ্যারিয়েট তুবমান অবার্ন, নিউইয়র্কে কেনা একটি বাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি স্কুল এবং অন্যান্য দাতব্য কাজের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। প্রাক্তন ক্রীতদাসদের সাহায্যের জন্য সব সময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। তাদের এই দেশের নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতে আন্দোলনও করেছেন তিনি। দিন শেষে সফলও হয়েছেন এই নারী।    

১৯১৩ সালের ১০ মার্চ ৯৩ বছর বয়সে মারা যান হ্যারিয়েট তুবমান। মারা যাওয়ার আগে তিনি নিউমোনিয়াতে ভুগছিলেন। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। গৃহযুদ্ধের সময় তিনি সরকারের পক্ষেও অনেক কাজ করেছেন। এসময় তিনি দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। ছিলেন রাষ্ট্রের একজন সৈনিকও। তবে এজন্য কোনো পেনশন বা আর্থিক সহযোগিতা পাননি তিনি। দাসত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সত্যিকারের নায়ক হিসেবে তাকে এখনো সম্মানিত করা হয়। স্মিথসোনিয়ার পরিকল্পিত ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আফ্রিকান আমেরিকান ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে হ্যারিয়েট তুবমান হয়ে থাকবেন চির স্মরণীয়। তার জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছে উপন্যাস।

সূত্রঃ ডেইলি বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top